বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
প্রকাশকাল: জুলাই ৬, ২০২৫
আধুনিক যুগে শুধু স্থল বা নৌ সীমান্ত রক্ষা করলেই চলবে না—বিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা ধরনের আকাশপথে হুমকির বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হয়। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষার বর্তমান সক্ষমতা, দুর্বলতা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
>>বর্তমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষার মূল শক্তি হল FM-90 (HQ-7B) নামের একটি স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এটি চীনা তৈরি একটি সিস্টেম, যা ফরাসি Crotale ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি।FM-90 একটি অত্যন্ত কার্যকর শর্ট-রেঞ্জ স্যাম সিস্টেম, যা প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে এবং প্রায় ৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত শত্রু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি বিমান, ড্রোন এবং নিম্ন উচ্চতায় উড়ে আসা বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী এই সিস্টেমকে বিভিন্ন কৌশলগত অঞ্চলে স্থাপন করে রেখেছে, যাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে আকাশপথে সুরক্ষিত রাখা যায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেটেও এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর হাতে রয়েছে MANPAD (মান-পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম), যেমন FN-6 এবং QW-2। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কাঁধে বহনযোগ্য এবং হেলিকপ্টার বা নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।এছাড়াও রয়েছে স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় বিমান বিধ্বংসী কামান(Anti Air Gun) ব্যবস্থা।
>>সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা
বর্তমান ব্যবস্থার কিছু বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। FM-90 মূলত স্বল্প পাল্লার জন্য উপযোগী হওয়ায় দেশের সামগ্রিক আকাশ প্রতিরক্ষায় তা এককভাবে পর্যাপ্ত নয়। দীর্ঘ পাল্লার শত্রু বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার মতো শক্তিশালী মধ্যম বা দীর্ঘ পাল্লার স্যাম সিস্টেম এখনো নেই।দীর্ঘপাল্লার রাডার কাভারেজের অভাব, দেশের সব অঞ্চল এবং সকল লেয়ার একটি পূর্ণাঙ্গ ও ইন্টিগ্রেটেড রাডার কাভারেজের আওতায় আসেনি।একই সঙ্গে, ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও সাইবার যুদ্ধের বিপরীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তুলনামূলক দুর্বল, এবং একাধিক লক্ষ্যবস্তু মোকাবিলায় সক্ষমতা সীমিত।এছাড়াও আধুনিক ফাইটার জেটের অভাবতো রয়েছেই।
তবে আজ শুধু আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই কথা হবে। @DefenceToday
>> এখন পর্যন্ত সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাংলাদেশে অপশন
বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যার মধ্যে সেনাবাহিনীর জন্য মধ্যম ও মধ্যম-দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার কথা শোনা যাচ্ছে। অপশন হিসেবে রয়েছে তুরস্কের HISAR-O, চীনের FK-3,HQ-17AE, দক্ষিণ কোরিয়ার KM-SAM Block II ও রাশিয়ার Buk-M2।
আর বিমান বাহিনীর জন্য দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনা হবে। এখানে অপশন হিসেবে চীনের HQ-9(FD-2000 export variant), তুরস্কের SİPER, রাশিয়ার S-350E Vityaz এগিয়ে থাকবে।
এগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে বিমান, সেনা ও নৌবাহিনীকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে এক বাহিনী অন্য বাহিনীকে রাডার, তথ্য ও প্রতিক্রিয়া দিতে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে দ্রুত শত্রু শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া মাল্টি-লেয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে বিমান, ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল, এমনকি স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
এছাড়াও, এই ড্রোন যুদ্ধের যুগে এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের আধুনিক বাস্তবতায়, বাংলাদেশকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে EW (Electronic Warfare), Anti-Jamming Technology, এবং Cyber-Defensive Measures–এর দিকে। ভবিষ্যতে ড্রোন এবং হাইপারসনিক অস্ত্র প্রতিরোধে লেজার ডিফেন্স সিস্টেম বা মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র ও রেইল গানের মত প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সীমিত ও পুরনো প্রযুক্তি নির্ভর হলেও ভবিষ্যতে এটিকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। আধুনিক যুগের যুদ্ধ সৈন্যের আগে ফাইটার, ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে লড়া হচ্ছে, তাই সবার আগে বাংলাদেশের আকাশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখনই প্রয়োজন—আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম সংগ্রহ, রাডার কাভারেজ বৃদ্ধি, সমন্বিত প্রতিরক্ষা কাঠামো গঠন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি। শুধু প্রতিরক্ষা নয়, আকাশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক যেন অটুট থাকে—এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
দেশ:
নিউজ ক্যাটাগরি:
জনপ্রিয় খবর